একটি স্বপ্নের মৃত্যু শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা

কয়েকদিন ধরে মায়ের কাছে জেদ ধরেছে সজিব সিংহ।এবার সে রসেয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাসফরে যাবে,এবং বন্ধুদের নতুন কিছু করে চমকে দেবে সবাইকে।মা অবশ্য না করেনি,ছেলে যে বায়না ধরেছে।
বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে তাই মা ও বাধা দেয়নি,কিন্তু বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা।
কালকে সজিবের শিক্ষাসফর বাবাকে সজিব কোনোরকমে রাজি করিয়েছে।
সকাল সকাল অন্য আট দশটা ছেলের মতই সজিব এসেছে পিকনিকে, বাবার কথা উপেক্ষা করে।
মায়ের মনে কিছু একটা ভয় ছিল, তাইতো বারবার ছেলের দিকে তাকিয়ে তার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল মা।
মায়ের মনে অজানা আশংঙ্খা কাকে বলবে সে কথা?
ছেলে যে পিকনিকে যেতে নাছোড়বান্দা ।

সজিব অন্য আট দশটা ছেলের মতোই স্কুল মাঠে চলে এসেছে,বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যাবে বলে।
আহা কত বন্ধু, কত মানুষের সমাগম, সজিবের দেখেই প্রাণ খুলে গেলো।
স্কুলে তার এইবারে প্রথম শিক্ষা সফর,ভাবতেই কিছুটা আহ্লাদী হেসে উঠে সজিব।
শিক্ষাসফরে নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করতে এসেছে যে।
বন্ধুদের প্রাচীরের এক কোণে দেখে সজিব কিছুটা এগিয়ে গেলো।
বন্ধুদের সে বড্ড ভালোবাসে, বন্ধুরাই তার প্রাণ, বন্ধুদের পেলেই কেমন জানি একটা প্রশান্তি ফিরে পায়।
সজিব সবসময় একটু কম কথা বলে কিন্তু বন্ধুদের দেখলে একটুও চুপ থাকতে পারেনা। মনে হয় সব কথাই বন্ধুদের খুলে বলি।বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া
তার চিরন্তন অভ্যাস।

ততক্ষণে স্কুল গেটের সামনে পিকনিক বাস এসে হাজির।
সকলের মধ্যে জমানো আবেগে আনন্দে আপ্লুত । কেননা আরেকটু পর যে,তারা শিক্ষা সফরে বের হবে। সজিবের দৃষ্টিকোণ জুড়ে তখন শুধু ৪২ সিটের বাসটি।
এত ছোট বাসে এতগুলো মানুষ কিভাবে শিক্ষাসফরে যাবে তা সজিবের ছোট মাথায় কুলায় না।
যাকগে সে ছোট মানুষ অত কিছু ভাববার প্রয়োজন বোধ করেনা।
হঠাৎ স্যারদের ডাক তোমরা সবাই বাসে উঠো, বলতেই সজিবের মোহ ভাংগে। অনেকেই তখন বাস দখলের চেষ্টায় সংগ্রাম করছে।
শিক্ষকরা তখন বলতে লাগলো তোমরা আস্তে আস্তে উঠো সবাই।
সজিবের প্রাণপণ চেষ্টা কিন্তু সিট পায়নি সে,বাসের ডানদিকে কোন রকমে বসে পড়লো।
তখন পর্যন্ত বাসটিতে একে একে ৯০ জন উঠানো হলো।
সজিবের মত, সকলের অবস্থাই প্রায় একই রকম কোনো রকমে বসে পড়ার মত।
সজিবের মনে প্রশ্ন জাগে এটাই মনে হয় শিক্ষাসফর।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাসটি গন্তব্য স্থলে রওনা হলো।
তার মনে আবার প্রশ্ন জাগে এটাই শিক্ষা সফর না কি?
না বস্তায় বন্দি হয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে রান্না খেয়ে ঘুরে আসা। সজিবের
শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে কারণ সজিবের বাবা তাকে বলেছিল, শিক্ষকরা হলো গুরুজন তারা যা ভাবে তুই তার দ্বিমত করবি না,তাই সজিব ও এইসব মাথা থেকে সরায়।
ততক্ষণে তার বন্ধুরা বড় ভাইরা সকলে একসাথে গান ধরে।

গানের সুর বাজতে থাকে "আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা "
এখন ই নামবে অন্ধকার "
সজিব গানের সুরে হারিয়ে যায় তার মাথায় কল্পনায় আচ করে , গাদাগাদি করে বসতে একদম ভালো লাগছেনা।
একটু ছোট খাট হিসেব করে। সজিব তার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছে এইবার শিক্ষাসফরের জন্য ৮০ জন ছাএ এর কাছ থেকে ২৫ হাজার আর আর বাকি মানুষদের কাছে ১১ হাজার এই শিক্ষা সফরের জন্য চাদা তোলা হয়েছে।
তার মাথায় আসে এত টাকা দিয়ে কি শুধুই একটি বাস?
সজিবের ছোট মাথায় কুলায় না,কারণ তার বাবা বলেছিল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দ্বিমত না করতে।
তাই সে এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসটি ততক্ষণে পঞ্চগড়ে পৌছায়।
সজিবের কানে আসে পঞ্চগড়,পঞ্চগড় তার বন্ধুদের হর্ষধ্বনি।
ছোটবেলায় একবার বাবার সাথে এসেছিল সজিব এইখানে।
বাবা তাকে বলেছিল, এইটা আমাদের জেলা শহর।তখন অবশ্য সজিব বুজতে পারেনি জেলা শহর আবার কি?
এখন সে বুজতে পারে!একবার সজিবের বাবা তাকে বলেছিল স্বপ্ন দেখতে, সজিব তখন বাবাকে প্রশ্ন করেছিল বাবা স্বপ্ন কি?
বাবা অবশ্য তখন বুজিয়ে বলেছিল।
এখন সজিব প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে।
কারণ স্বপ্ন দেখতে সে শিখে গেছে , একদিন অনেক বড় মানুষ হবে।
বাবা তাকে বলেছিল সুবোধ হতে, একজন ভাল মানুষ হতে। সেটাই হতে চায় সজিব। তাই সে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে আট দশটা মানুষের চেয়ে আলাদা হবে।
মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই,বাসটি তেতুলিয়া এসে পৌছাল,সবাই বলতে লাগলো আর কিছুদুর সজিবের মনে কিছুটা আনন্দের স্মিত হাসি আরেকটু পরে যে প্রাণের শিক্ষা সফরে তারা এসে যাবে।

এইভাবেই কিছুদূর যেতে যেতে বন্ধুরা চিৎকার করে উঠলো কাজী ফার্মস।
আহা কি মনোরম দৃশ্য!
সজিবের প্রাণ খুলে গেল
ইশ কি সুন্দর জায়গা।
এত কস্ট সব সার্থক।

বেলা তখন ১১ বন্ধুরা যে যার মত আনন্দ করছে , কাচা রাস্তা দিয়ে বাসটা ঢুককে পড়লো, স্যাররা বলল এই জায়গার নাম রওশনপুর আর কিছুদূর এই ডাক বাংলো।
হঠাৎ একটি ট্রাক সামনে চলে আসলো সজিবের মনে অজানা আশংকা।কিছু হবে নাকি বাসটি এক পাশে সাইড দিতে গিয়ে, কিছু বুজে উঠার আগেই একটা বিকট আর্তচিৎকার সজিবের মাথায় এলো।
ততক্ষণে সজিব বুজতে পারলো, বাসটি আসলে উলটে পড়ে গেছে।
সজিব বুকে কিছুটা ব্যাথার আচ পেল।তার মনে হলো কেউ তার গলায় চেপে ধরেছে।
বন্ধুদের সে দেখতে পেল,সবাই বের হয়ে যাচ্ছে,কেউ কারো কথা শুনছে না,সজিবের দুই সিট তার মাথায় লেগে গেছে সে অপ্রাণ চেষ্টা করছে মাথা থেকে সরানো, কিন্তু কিছুতেই পারছেনা।
সজিব বন্ধুদের ডাকছে,
তার শিক্ষকদের ডাকছে।
বাইরের মানুষদের ডাকছে,
কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছেনা।
সজিবের চোখ দিয়ে আলতো করে পানি বের হয়ে আসে।
সে একবার বই পড়ছিল "স্বার্থপর " শব্দটা কিন্তু তখন সে বুজতে পারেনি স্যার তাকে বুজিয়ে বলেছিল এখন সজিবের মনে হয় এটাই বুঝি স্বার্থপরতা।
তখন সজিবের তার বোনের কথা মনে পড়ে, যার সাথে সে সময় খুনসুটি ঝগড়া করছে,এখন তার বোনের খুব দরকার।
সজিব চিৎকার করে বলতে চাচ্ছে বোন তোর সাথে আর ঝগড়া করব না রে।
প্লিজ তুই এইখানে আয় আমার খুব কস্ট হচ্ছে।আমাকে এইখানে থেকে বের কর ফেল।
তোর সাথে আর ঝগড়া করব নারে

এবার সজিবের তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়,ছোট বেলায় বাবার কাছে দেবীবাজার গিয়েছিল তখন সে বায়না ধরেছিল একটা রিমোট কন্টোল গাড়ি নিতে,বাবার কাছে টাকা ছিলনা তাও বাবা কস্ট করে কিনে দিয়েছিল
সেই বাবা সজিবকে সুবোধ এর মানুষ বানাবে বলে।
সজিববের মনে হয় বাবা আর জেদ করব না প্লিজ তোমার আমাক একটু শ্বাস নিতে দাও।
আসো না বাবা আসো না!

এবার সজিবের স্পষ্ট মায়ের মুখটা ভেষে উঠে মা ও মাগো আর পারছিনা।
মা শরীরটা প্রচন্ড ব্যাথায় কাত হয়ে গেছে মা।
আসো না মা,জন্মের পর যতবার পরে গেছি তুমিই তো মা তুলে উঠাইছো মা"
মা সত্যি বলছি আর তোমাকে বিরক্ত করবনা মা।

এখন প্রতিদিন স্কুলে যাব মা!
বোনের সাথে আর ঝগড়া করবোনা মা।
তোমার প্রতিটাই কথা শুনবো মা।
মা মা তাও আমি বাচতে চাই মা।
মা মা
তোমার
আচলে মুখ মুছতে চাই মা!
মৃত্যু ক্ষুথায় কাতরাচ্ছি মা!
এসো না মা মা!

আরো কোনো কথা বের হয় না.............

Comments

Popular Post

বাস্তবতা

ছাত্রজীবনে (Freelancing) ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার

ফাইবার মার্কেটপ্লেস এ যেভাবে গিগ বা সার্ভিস তৈরি করতে হয়